এটা কোনো হোস্টেল বা মেসের রুম নাম্বার নয়। এটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের রুম নাম্বার। আমি সিফাত ইসলাম। ২০১৮ সালে এইচএসসি পাশ করেছি। ২০১৮-১৯ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আব্বুর চিন্তা ছিল এইচএসসি পাস করব কি না! আল্লাহর অশেষ রহমতে আর শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় ভালো রেজাল্ট করলাম। ১২ বছর বাবা মায়ের শাসনে লেখাপড়া করেছি। এবার একটু স্বাধীনতা নিয়ে বাইরের পরিবেশে যাওয়ার কথা ভাবতে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখি। প্রথমে বাবা নাকচ করলেও পরবর্তীতে আত্মীয়দের কথায় রাজি হন। যাই হোক, দুর্ভাগ্যক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছিটকে যাই। বাবা ক্ষণিকের জন্য মনক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। নিজের ওপর আর আল্লাহর ওপর অটুট বিশ্বাস রেখেছিলাম।
ঢাকার পরীক্ষার পর জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর কোনো জায়গাতে ঠাঁই না পেয়ে পরীক্ষা দিলাম রাজশাহীতে। এখানে আমার ছোট মামা নাট্যকলা বিভাগে পড়াশোনা করত। তার কাছেই থাকব আমি। রাবি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই দেখি থই থই করছে পরীক্ষার্থী। প্রাণবন্ত রাজশাহী ক্যাম্পাস দেখে মুগ্ধ হলাম। মামা অপেক্ষা করছিল। মামার সঙ্গে গেলাম শাহ মখদুম হলে।মামা থাকতো ২৫৩ নাম্বার রুমে। আমি আর আমার বন্ধু রুমে বসলাম। মামা তখন হলের নিয়মকানুন ও পরিবেশ সম্পর্কে বললেন। আমরা দুজনই নই, আমাদের মতো আরো অনেকেই ছিল। তারাও পরীক্ষা দিতে এসেছে। পরদিন সকালে ও বিকালে আমার পরীক্ষা ছিল। সারাটা বিকাল বিশ্রাম করে সন্ধ্যায় একটু বের হলাম। আমার আরেকটা বন্ধু এসেছিল আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য।
একসঙ্গে হলের ডাইনিংয়ে রাতের খাবার পর্ব শেষ করে রুমে যাই। একটু পড়াশোনা করব কিন্তু রুমের বাতিগুলা নষ্ট ছিল। মাত্র দুইটা টেবিল ল্যাম্পে আমরা ১০ জন। রাতে আরো দু’জন এল কুমিল্লা থেকে পরীক্ষা দিতে। মোট ১১ জন ছিলাম একরুমে। পরদিন পরীক্ষা ছিল আমার। সকাল ৯ টায় ও বিকাল ৪ টায়। সকালে E ইউনিট এর পরীক্ষা আশানুরূপ হয়নি। মনমরা হয়ে ফিরে এসেছিলাম ২৫৩ নাম্বার রুমে। চোখে যেন অন্ধকার দেখছি। অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু শেষ আশাটা হয়তো পূর্ণ হবে না।
একটু বিশ্রাম করে বিকালের পরীক্ষাটা দিলাম। এই পরীক্ষাটা অনেক ভাল হয়েছিল। পরীক্ষা শেষে সন্ধ্যায় যখন সাবাস বাংলাদেশ মাঠে সবাই জড়ো হয়েছি, তখন সবার মুখে শুনি একই কথা। পরীক্ষা খুবই ভাল হয়েছে। তখন আবারো চোখে অন্ধকার দেখি। মানে খুব বেশি ভাল যাদের হয়েছে, তারাই সুযোগ পাবে। তাই আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম বলতে গেলে।
পরদিন সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে এলাম। পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে পারিনি। কারণ একদিন পরেই চবিতে পরীক্ষা। তাই বাড়িতে ফিরে আসি। পরদিন বিকালে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরীক্ষাটা আল্লাহর রহমতে ভাল হয়। পরীক্ষা দিয়ে সন্ধ্যায় চবি ক্যাম্পাসে ঘুরছি। হঠাৎ স্যারের ফোন।
– হ্যালো, আজকে রাবির A ইউনিটের রেজাল্ট দিয়েছে। কী অবস্থা…?
– স্যার জানি না। আমি তো চবি ক্যাম্পাসে। রুমে গিয়ে দেখে জানাচ্ছি। স্যার বললেন, দ্রুত দেখে জানাও।
কীভাবে দ্রুত দেখব? রুমে গিয়ে দেখি রাবির এডমিট কার্ড বাড়িতে। বন্ধুরা রেজাল্ট দেখছে। কারো হয়নি। এদিকে আমার আশার প্রহর বাড়ছে। বাড়িতে ফোন করে রোল জেনে নিলাম। বন্ধুকে বললাম, দেখো কী অবস্থা? প্রথম বার রোল দেওয়ার পর ইরোর দেখায়। আমি তো আরো ভয় পেলাম। তাহলে হয়তো ফেল। আরেক বন্ধু বলল, দোস্ত তোর হয়ে গেছে। আমি বললাম, না দেখেই। দে দেখি। ও বলল ৩১০ সিরিয়াল।আমি ফোন হাতে নিয়ে দেখে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। অবশেষে আল্লাহ মুখ তুলে তাকাল। ঈদের চাঁদ যেন হাতে পেয়েছি। সবাইকে ফোনে জানালাম খুশির সংবাদ। প্রিয় ফারুক স্যারও অনেক খুশি। যার হাত ধরে আমার এই আনন্দ।
সেই আনন্দ নিয়েই বাড়ি ফিরলাম। ফিরে দেখি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও সিরিয়াল। সিদ্ধান্ত নিলাম রাজশাহীতেই পড়ব। দিনগুলো ভালই কাটছিল। ভাইভার অপেক্ষায় আছি। তারিখ নির্ধারিত হয়ে গেল। আবার রাজশাহীতে এলাম। আগের সেই শাহ মখদুম হলের ২৫৩ নাম্বার রুমে। এসে নতুন আরেক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। তাজ ভাই। ভাইভা ভালভাবে সম্পূর্ণ করে আবার বাড়িতে ফিরলাম। কিছুদিন পর সাব্জেক্ট আসে ভাষা সংস্কৃত। আমি হতাশ হয়ে পড়ি। কী করব? ভর্তি হব কি না! মামাকে ফোন দিলাম। বললেন, ভর্তি হয়ে যাও। মাইগ্রেশনের মাধ্যমে সাব্জেক্ট পরিবর্তন করা যায়। ভর্তি সময় আবারো আশ্রয় নিলাম সেই ২৫৩ নম্বর রুমে। ভাইয়াদের কাছ থেকে পদ্ধতি জেনে ভর্তি কার্যক্রম সম্পূর্ণ করলাম। এখন আমিও একজন রাবিয়ান। কিছুদিন পর মাইগ্রেশন করলাম। নতুন সাব্জক্ট ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি।
২১ জানুয়ারি ২০১৯, অরিয়েন্টেশন। ২২ তারিখ থেকে ক্লাস। ২০ তারিখ রাজশাহীতে এলাম। কেউ এসে মেস ঠিক করে। কেউ বা আগেই ঠিক করে রেখেছিল। আমি কিছুই করিনি। জানতাম আমার জন্য ২৫৩ নাম্বার রুম সবসময় খোলা থাকবে। হ্যাঁ, এখান থেকেই আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু। তারপর ১ মাস ক্লাস করি। মাঝে মধ্যে মনে হলো কখনও তো মেসে থাকিনি। এই অভিজ্ঞতারও দরকার আছে। তাই কাজলাতে একটা মেসে উঠি ২ মাসের জন্য। নতুন অভিজ্ঞতা, মেস লাইফ। কিন্তু বেশিদিনের জন্য নয়৷ সেখানে আমি ২৫৩ নাম্বার রুমের সেই মজাটা পেতাম না। হলের বড় ভাইদের শাসন, ভালবাসা, আনন্দ, আড্ডা অন্যরকম একটা পরিবেশ। যেটা মেসে অনুপস্থিত। তাই ভাবলাম মেসে আর থাকব না। আবার ফিরে গেলাম ২৫৩ নাম্বার রুমে।
হিরু ভাই, তাজ ভাই, জ্যামি মামা আর আমি।হিরু ভাইয়ের পড়াশোনা শেষ। বিসিএস প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। তাজ ভাইয়ের ফাইনাল সেমিস্টার চলছে। আর মামা মাস্টার্সে পড়ছেন। আমি সবার জুনিয়র। তাই সবাই ভালবাসত, আবার শাসনও করত। প্রতি শুক্রবার রুমে আমরা সবাই মিলে রান্না করতাম। মামা কোনদিন হাত লাগাতো বলে মনে হয় না। শুক্রবারের অন্যতম চমক শুরু হয় রাত ১২:০১ মিনিটে। আর সেটা হলো ভূত এফএম। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এলেও সময়টা যেন ২৫৩ এর মতো কাটে না। ভাইদের ভালবাসা, তাদের সঙ্গে কাটানো সময়, যার কোনো ব্যাখ্যা হবে না।
প্রথম বর্ষ পরীক্ষা শেষে ২য় বর্ষের ক্লাস শুরুটাও হয়েছিল এখান থেকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো আর আমাকে এখানে সারাজীবন থাকতে দিবে না। কারণ আমি এখানে ছিলাম মামার রেফারেন্সে। তাই আমারও চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে। এ মাসের ৪ তারিখে আমি ১ বছরের স্মৃতিগুলো ফেলে রেখে চলে এলাম। এসব কিছু চিরস্থায়ী নয়। তারপরও হিরু ভাইয়ের শাসন ও শিক্ষা, মামা আর তাজ ভাইয়ের আদর, ভালবাসা রয়ে যাবে স্মৃতি হিসেবে। এটাকে ধারণ করেই হয়তো কেটে যাবে ক্যাম্পাস লাইফ।